Ticker

5/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

Responsive Advertisement

চা ওয়ালার গল্প...

লোকটার বয়স ৬০ বছরের মতো। আমি যে জায়গাটায় বিকেলে টুকটাক চেম্বার প্র্যাকটিস করি, তার কাছেই একটা ঝুপড়ি দোকানে সে চা-বিস্কুট-সিগারেট বিক্রি করে। আমার স্পষ্ট মনে আছে বছর দুয়েক আগে যখন সে আমার কাছে এলো তখন তার তীব্র জ্বর এবং শ্বাসকষ্ট। আমি নিউমোনিয়ার চিকিৎসা দিয়ে ১ মাস পর আরেকটা বুকের এক্সরে করে ফলো আপে আসতে বললাম...

এসব ক্ষেত্রে যা হয় আর কি, ভালো হয়ে গেলে সাধারণত ফলো আপে আর আসে না। চা ওয়ালা সেই রফিক সাহেব( ছদ্মনাম) আসলেন। লোকটার এখন কোন সমস্যা নেই, এরপরও তিনি চেস্ট এক্সরে করে এসেছেন, আমি বলেছি তাই নাকি তিনি এসেছেন...
আমি এক্সরের দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছি। এতোদিনে চেস্ট এক্সরেতে যে শ্যাডো ছিলো সেটা চলে যাবার কথা, শ্যাডোটা চলে যায় নি, এটা নিয়েই চিন্তিত, এটা Lung tumor হবার সমূহ সম্ভাবনা। আমি লোকটার দিকে তাকালাম, হাসি হাসি শুকনো একটা মুখ, জ্বলজ্বলে তার চোখদুটোয় আমার প্রতি তার প্রগাঢ় বিশ্বাসটা আমি টের পাই...
বেইজলাইন কিছু রক্ত পরীক্ষার সাথে বুকের সিটি স্ক্যানটাও করে নিয়ে আসতে বললাম। এসেছিলেন অনেকটা এমনি এমনি, এসে এখন শুনলেন রক্ত পরীক্ষার সাথে সাথে সিটি স্ক্যানও করতে হবে। চা বিক্রির একটি ঝুপড়ি দোকান চালিয়ে যে লোকের সংসার চলে তার জন্য একটা সিটি স্ক্যান মুখের কথা না, লোকটা ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন...
তারপরের ঘটনাক্রমগুলো অনেকটা এরকমঃ
লোকটি তার ছেলে ও স্ত্রীসহ করুণভাবে আবার আমার শরণাপন্ন হলেন যে তাকে সাহায্য করতে হবে। আমি তার করুণকন্ঠে পরাস্ত হলাম। 'পরাস্ত হলাম'- কথাটা এজন্য বললাম কারণ আমি সাধারণত কারো জন্য কোথাও ফোন করি না, যাকে ফোন করে রিকোয়েস্ট করবো সে উটকো ঝামেলা মনে করতে পারে, নিজেকে তখন ছোট মনে হবে...
নিজের কথা বাদ দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে পোস্টেড এক জুনিয়রকে ফোন দিলাম, রোগীর কথা বলে এডমিট করার ব্যবস্থা করলাম, সামগ্রিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করলাম। বক্ষব্যাধী হাসপাতালের এক কলিগকেও মেসেজ দিয়ে জানিয়ে রেখেছিলাম যে সাহায্য লাগতে পারে...
ঢাকা মেডিকেলেই চিকিৎসা চললো, ফুসফুসের ক্যান্সার ধরা পরলো, রেডিওথেরাপি + কেমোথেরাপি স্টার্ট হলো, আমি ফোনে ফোনে আপডেট পাই...
হঠাৎ একদিন চেম্বারে আবার রফিক মিয়ার আগমন। তিনি ঢাকা মেডিকেলে আর চিকিৎসা নিবেন না, আর যে কয়দিন বেঁচে থাকবেন আমার কাছেই নাকি আসবেন। তাকে বোঝালাম, কাজ হলো না, হয়তো টাকা পয়সাও শেষ হয়ে এসেছিলো। জীবনের শেষ কয়দিন কয়েকবার এসেছিলেন আমার চেম্বারে, আমি আর ভিজিট রাখি নাই। মৃত্যুপথযাত্রী একজন মানুষের কাছ থেকে টাকা নিতে আমার মনটা সায় দেয় নাই...
রফিক মিয়া মারা গেলেন। আমাকে জানানো হয়েছিলো। মানুষের মৃত্যু আমাকে এখন তেমন স্পর্শ করে না, কালক্রমে আমি রফিক মিয়াকে ভুলে গেলাম...
তারপর মাস ছয় কেটে গেছে। স্থানীয় এক রোগী আমার চিকিৎসা নিতে আসলেন। হিস্ট্রি, ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন শেষ করে লোকটার আগের চিকিৎসার ফাইল ঘেঁটে দেখছি। সেটা দেখতে গিয়ে ফাইলের ভেতর একটি ছোট চিরকুটে আমার নামটা দেখতে পেলাম। কাঁপা কাঁপা অপরিপক্ক হাতে ভুল বানানে আমার নামটা লেখা। ডা.আসাদুজ্জামান এর পরিবর্তে আমার নাম লেখা হয়েছে "ডাকতার আসাদুর জামান"...
এটা কার লেখা জানতে চাইলাম। স্থানীয় লোকটি বললো এটা নাকি সেই চা ওয়ালা রফিক মিয়ার লেখা। জীবনের শেষ কয়দিন চায়ের দোকানে লোকদের চা বানিয়ে খাওয়াতেন আর চিকিৎসা সংক্রান্ত কোন কথা উঠলে আমার কাছ থেকে সবাইকে চিকিৎসা নিতে বলতেন, তিনিই নাকি আরেকজনের সাহায্য নিয়ে কোনরকমে একটা কাগজে আমার নামটা লিখে এই লোকটিকে তা ধরিয়ে দিয়েছিলেন...
মৃত্যুপথযাত্রী একজন মানুষ তার অসীমতার পথে অনন্ত যাত্রা নিশ্চিত জেনেও কি এক অসাধারণ নির্ভরতা, ভরসা ও তীব্র বিশ্বাস নিয়ে রোগীকে আমার কাছে রেফার করতেন!!! ভালোবেসে মানুষদের কাছে আমাকে নিয়ে গল্প করতেন!!!- এটা ছিলো আমার জন্য অনেক বড় একটা পাওয়া। আমি চিরকুটটার দিকে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম...
আমার চা ওয়ালার গল্প বলা শেষ। আপনারা এই গল্প এবার ভুলে যেতে পারেন...
বর্তমানে ফেরত আসি। নতুন পাশ করা এক চিকিৎসকের কথা বলি। বিসিএস হেল্থ ক্যাডারে নতুন জয়েন করেছে। আমার সাথে কথোপকথনে অনেক কথা বললো, অন্যান্য ক্যাডারের অনেক ক্ষমতা, চিকিৎসকদের কোন ক্ষমতা নেই, তাই নতুন এই চিকিৎসক বেশ হতাশ...
অনেকটা মিসগাইডেড এই নবীণ চিকিৎসককে আমার মনের অনেক কথাই বলা হয়নি। আপনাদের বলি। একেক ক্যাডারের ক্ষমতা একেক রকম, ডাক্তারদের ক্ষমতা রোগীর প্রতি ভালোবাসা ও ডেডিকেশনের মাধ্যমে তার মনের অন্দরমহলে প্রবেশ করতে পারা...
আমার ফ্রেন্ড লিস্টে অনেক নবীণ ও হবু চিকিৎসক আছেন। আপনারা নানা ভাবে আপনাদের পেশাগত জীবনে মিসগাইডেড হবেন। তাদের জন্য বলি, একজন চিকিৎসক হিসেবে দুটো জিনিস সারাজীবন নিশ্চিত করবেনঃ
১. একাডেমিক্যালি নিজেকে আপগ্রেড থেকে আরো আপগ্রেড করবেন এবং রোগীর কল্যাণার্থে সেই জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটাবেন। মনে রাখবেন -যেদিন থেকে নিজেকে আপগ্রেড করা বন্ধ করবেন, সেদিন চিকিৎসক মনের মৃত্যু ঘটবে...
২.রোগীর প্রতি ডেডিকেশন নিশ্চিত করবেন, রোগী যদি আপনার প্রতি ভ্রুকুটি উঠায়, তবে আপনিও তার সাথে সাথে উত্তেজিত হবেন না, মনে রাখবেন রোগীর সাথে আপনার সম্পর্ক ক্ষমতা প্রদর্শনে নয়। রোগী উত্তেজিত হলে বের করুন কেন সে আপনার প্রতি রুষ্ট। আপনার সীমাবদ্ধতা থাকলে সেটা বুঝিয়ে বলুন। রোগীরা আমাদেরই কারো ভাই বা বোন, আপনি বুঝিয়ে বললে তারা বুঝবেন। মনে রাখবেন, আগুনকে আগুন দিয়ে নেভানো যায় না, সেখানে পানি প্রয়োজন ...
কথা দিচ্ছি, এই দুটো জিনিস নিশ্চিত করতে পারলে আপনাকে কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না, মানুষই তখন আপনার ক্ষমতা নিশ্চিত করবে এবং সে ক্ষমতা হবে চিরস্থায়ী...
নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের অন্যতম মৌলিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন চ্যাপলিন। শৈশবে দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত চ্যাপলিন মাত্র ৩০ বছরের মাঝে পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী লোক হয়ে উঠেন। জীবনের প্রতিটি বাঁক ও তার স্বরূপ ছিলো এই লোকটির পরিচিত। সেই চার্লি চ্যাপলিনের একটা কথা বলে লেখাটা শেষ করিঃ
"You need power only when you want to do something harmful, otherwise love is enough to get everything done..."
এটা ছিল এক চা ওয়ালার গল্প, সত্যিকারের গল্প...
©Dr. zaman Alex

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ