গর্ভাবস্থায় হরমোনের প্রভাবে দৈহিক ও প্রাণ রাসায়নিক পরিবর্তনের সাথে পুষ্টি উপাদানের চাহিদার সম্পর্ক রয়েছে। গর্ভধারণ স্তন্যপায়ী প্রাণীর জীবন চক্রের একটি স্বাভাবিক ক্রিয়া। গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধির জন্য সকল পুষ্টি উপাদানই আসে মায়ের শরীর থেকে। যদিও মায়ের ও গর্ভস্থ শিশুর মধ্যে সরাসরি কোন যোগ নেই। তবে প্লাসেন্টা বা ফুলের মাধ্যমে শিশু ও মায়ের রক্তের উপাদান সমূহ আদান-প্রদান হয়ে থাকে। এভাবে মায়ের রক্তের পুষ্টি উপাদান গুলি শিশুর চাহিদা অনুযায়ী শিশুর রক্তে আসে এবং তার দেহের গঠন ও পুষ্টি সাধন করে।
শিশু নয় ৩৭ কমপক্ষে সপ্তাহ গর্ভে থাকে। প্রথম চার মাসে বৃদ্ধি খুব কম হয়। চার মাসের পর থেকে গর্ভস্থ শিশুর দেহ গঠনের উপযুক্ত অতিরিক্ত পুষ্টি উপাদান সহ খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। পুষ্টির চাহিদা অনুযায়ী গর্ভাবস্থা কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১. প্রথম ১২ সপ্তাহ
২. দ্বিতীয় ১৬ সপ্তাহ
৩. তৃতীয় ৯/১০ সপ্তাহ
এই তিনটি ভাগের সময় এর উপর পুষ্টির চাহিদার তারতম্য হয়ে থাকে। গর্ভাবস্থায় যেসকল পুষ্টি উপাদানের চাহিদা বাড়ে সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হল:
ক্যালরীর হিসেব:
গর্ভাবস্থায় মোট চাহিদার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। কারণ ভ্রূণের বৃদ্ধির জন্য গর্ভকালীন সময়ে ২৮০ দিন মায়ের মোট শক্তির প্রয়োজন হয় ৮০০০০ কিলোক্যালরি। এই পরিমাণ ক্যালোরি জন্য প্রথম তিন মাসে দৈনিক অতিরিক্ত ১০০ কিলো ক্যালোরি ও শেষ তিন মাসে দৈনিক অতিরিক্ত ৩৫০ কিলো ক্যালরি খাদ্য গ্রহণ করা উচিত।
অর্থাৎ গর্ভাবস্থায় মোট ৭৫০০০ থেকে ৮০০০০ কিলোক্যালরি প্রয়োজন। এই শক্তির চাহিদা নির্ভর করে পর্যাপ্ত ক্যালোরি গ্রহণ ও পরিশ্রমের উপর। ক্যালরি চাহিদা বৃদ্ধি পায় বিভিন্ন কারণে। যেমন: থাইরয়েড সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে।
সুস্থ মহিলাদের জন্য প্রতিদিন প্রতি কেজি ওজনের জন্য ৩৬ কিলোক্যালরি ধার্য করা হয়েছে। পর্যাপ্ত ক্যালরির অভাবে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়। কারণ ভ্রূণ সবচাইতে বেশি গ্লুকোজ ধার্য করে নেয়।
ক্যালসিয়াম:
গর্ভস্থ শিশুর অস্থি গঠনে ক্যালসিয়াম অপরিহার্য। ভূমিষ্ঠ শিশুর অস্তিত্বে প্রায় ২৮ গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে। গর্ভবতী মাকে এই ক্যালসিয়াম সরবরাহ করতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও পুষ্টি বোর্ড গর্ভবতী মায়ের জন্য তাদের স্বাভাবিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত ৫০মিলিগ্রাম অনুমোদন করেছেন। মায়ের খাদ্যে ক্যালসিয়াম এর অভাব থাকলে মায়ের অস্থি থেকে এই খনিজ পদার্থটি অপসারিত হয়ে শিশুর চাহিদা পূরণ করার প্রয়াস পায়।
প্রোটিন:
গর্ভাবস্থায় প্রোটিনের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। শিশুর দেহগঠন এই উপাদানের উপর নির্ভরশীল। জরায়ু এবং মাতৃদেহের বিভিন্ন কোষ এইসময় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এ সময় দেহ অতি দক্ষতার সাথে খাদ্যে প্রোটিন কে ব্যবহৃত করতে সক্ষম হয়। হিসাব করে জানা গেছে, প্রতিটি গর্ভের জন্য ৯০০ থেকে ৯৫০ গ্রাম অতিরিক্ত প্রোটিন এর দরকার হয়। প্রথম তিন মাসে শিশুর দেহ গঠন এর পরিমাণ অতি সামান্য হওয়ায় পরবর্তী ছয় মাসে এই চাহিদা পূরণ করতে প্রত্যহ অতিরিক্ত ৬ গ্রাম আদর্শ প্রোটিন অথবা ১০ গ্রাম উচ্চমানের আদর্শ প্রাণীজ প্রোটিন এর প্রয়োজন। অন্যকথায় ১০ থেকে ১৫ গ্রাম উদ্ভিজ্জ প্রোটিন খাবার সুপারিশ করা হয়েছে।
লৌহ/Iron জাতীয় খাবারঃ
গর্ভবতী মায়ের লোহার চাহিদা অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। গর্ভস্থ শিশু ও প্লাসেন্টার গঠন এবং মায়ের নিজের রক্তের লোহিত কণিকার পরিমাণ বৃদ্ধি এই দুই কারণেই এ সময় মাকে প্রচুর যুক্ত খাদ্য দেওয়া উচিত। গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ১০ মিলিগ্রাম লৌহ সুপারিশ করা হয়েছে। মায়ের খাদ্যে প্রচুর লোহা থাকলে গর্ভস্থ শিশুর যকৃতে যথেষ্ট সঞ্চিত হতে থাকে। শিশু জীবনের প্রথম কয়েক মাস শুধুমাত্র দুধ পান করে বেঁচে থাকে। দুধে লোহার পরিমাণ খুবই কম থাকায় এ সময় শিশুর দেহের চাহিদা মেটাবার জন্য তার নিজের যকৃত সঞ্চিত লোহা ব্যবহৃত হতে পারে। এইজন্য গর্ভবতী মায়ের পর্যাপ্ত লৌহ সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন :ডিম, মাংস, পালং শাক, লাল শাক, পুঁইশাক, সবজি গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
আয়োডিন :
গর্ভবতী মায়ের খাদ্য যাতে পর্যাপ্ত আয়োডিন থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। দৈনিক অতিরিক্ত ১৫৫ মিলিগ্রাম বাড়িয়ে দিতে হবে আয়োডিনের পরিমাণ। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ গর্ভবতী মা আয়োডিনের অভাবে গয়টার রোগে ভোগে। সেজন্য এর প্রয়োজন অত্যন্ত সামান্য হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সোডিয়াম:
গর্ভাবস্থায় সোডিয়াম গ্রহণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দিনে ২০০ মিলিগ্রাম এর কম খেতে হবে।
বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন:
ভিটামিন এ শিশুর চোখ, ত্বক ইত্যাদির জন্য খুবই প্রয়োজন। গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ভিটামিন এ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। এ জন্য নিয়মিত গাজর, টমেটো, মিষ্টি কুমড়া, হলুদ ও সবুজ শাকসবজি এবং ছোট মাছ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
ভিটামিন ডি হাড় ও দাঁত গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। গর্ভবতী মাকে অতিরিক্ত ৭.৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন খেতে হবে।
ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এর চাহিদা এ সময় বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে থায়ামিন এর চাহিদা। এজন্য ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার গর্ভাবস্থায় গ্রহণ করা বিশেষ জরুরী।
ফলিক এসিডের অভাবে গর্ভবতীমায়ের এনিমিয়া হয়।এ রোগে লোহিত রক্ত কণিা অপরিণত ও আকারে বড় হয়।এজন্য অতিরিক্ত ২০০-৮০০ মিলিগ্রাম ফলিক এসিডের প্রয়োজন।
শুধুমাত্র খাদ্যের দিকেই নজর দিলে হবে না পাশাপাশি মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিতে হবে। কেননা গর্ভাবস্থায় মায়ের আবেগ, উৎকণ্ঠা শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। যেসব মা গর্ভাবস্থায় রাগ, ক্রোধ, ভয়, উদ্বেগের মধ্য দিয়ে সময় পার করে তাদের সন্তানেরা বিভিন্ন মানসিক জটিলতায় ভুগে। যেমন :শিশু খিটখিটে মেজাজের হয়, তার মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, পাশাপাশি শিশু চঞ্চল প্রকৃতির হয়।
তাই মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য লেবু,ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার,চকোলেট,টমেটো,মিষ্টি আলু,ভিটামিন বি ১২,আপেল,গ্রিন টি,টক দই,কাজুবাদাম,আখরোট,ওটমিল,ফলমূল, পেঁয়াজ, রসুন,টাটকা ও সতেজ সবুজ শাকসবজি খেতে হবে।কেননা এসব খাবার মানসিক স্বাস্থের উন্নতি ঘটায় ও মন ভালো রাখে।
0 মন্তব্যসমূহ